শীতকালে শুকনো চুল চিরুনি দিয়ে আঁচড়িয়ে তোমাদের প্রায় সবাই নিশ্চয়ই কখনো না কখনো ছোট ছোট কাগজের টুকরাকে সেই চিরুনি দিয়ে আকর্ষণ করেছ। শীতপ্রধান দেশে শীতকালে বাতাস খুব শুকনো থাকে, তখন ছোট শিশু যখন কার্পেটে হামাগুড়ি দেয় তখন তাদের চুল খাড়া হয়ে যায়, দেখে মনে হয় একটি চুল বুঝি অন্য চুলকে ঠেলে খাড়া করিয়ে দিয়েছে। তোমরা সবাই নিশ্চয়ই ঝড়ের রাতে আকাশ চিড়ে বিদ্যুতের ঝলককে নিচে নেমে আসতে দেখেছ।
কাগজের আকর্ষণ, চুলের বিকর্ষণ কিংবা বজ্রপাত— এই তিনটি ব্যাপারের মূলেই কিন্তু একই বিষয় কাজ করেছে, সেটি হচ্ছে চার্জ বা আধান। চার্জ বা আধান কী, কেন সেটা কখনো আকর্ষণ করে, কখনো বিকর্ষণ করে আবার কখনো বিদ্যুৎ ঝলক তৈরি করে বোঝার জন্য আমাদের একেবারে গোড়ায় যেতে হবে, অণু-পরমাণু কেমন করে তৈরি হয় সেটা জানতে হবে।
আমরা সবাই জানি সবকিছু অণু-পরমাণু দিয়ে তৈরি। পৃথিবীতে 118টি পরমাণু আছে, এর মাঝে মাত্ৰ ৪3টি টেকসই, মাত্র এই কয়টি পরমাণু দিয়ে লক্ষ লক্ষ ভিন্ন অণু তৈরি হয়েছে। একটা অক্সিজেন পরমাণুর সাথে দুটো হাইড্রোজেন পরমাণু দিয়ে পানি, একটা সোডিয়াম পরমাণুর সাথে একটা ক্লোরিন পরমাণু দিয়ে লবণ, একটা কার্বন পরমাণুর সাথে চারটা হাইড্রোজেন পরমাণু দিয়ে রান্না করার গ্যাস ইত্যাদি ইত্যাদি। (অবাক হবার কিছু নেই বাংলায় মাত্র পঞ্চাশটা বর্ণ, সেই বর্ণমালা, দিয়ে হাজার হাজার শব্দ তৈরি হয়েছে।)
পরমাণু হচ্ছে সবকিছুর বিল্ডিং ব্লক (Building Block)। এই পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে ছোট একটা নিউক্লিয়াস, তাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে ইলেকট্রন। নিউক্লিয়াস তৈরি হয় প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে। এর ভেতরে প্রোটনের চার্জ হচ্ছে ধনাত্মক বা পজিটিভ (নিউট্রনের কোনো চার্জ নেই) আর ইলেকট্রনের চার্জ ঋণাত্মক বা নেগেটিভ। প্রোটন আর ইলেকট্রনের চার্জ সমান কিন্তু বিপরীত অর্থাৎ তার মান ( coulomb) কিন্তু একটা পজিটিভ অন্যটা নেগেটিভ। একটা পরমাণুর নিউক্লিয়াসে যে কয়টা প্রোটন থাকে তার বাইরে ঠিক সেই কয়টা ইলেকট্রন ঘুরতে থাকে তাই পরমাণুর সম্মিলিত চার্জ শূন্য, অর্থাৎ পরমাণু হচ্ছে বিদ্যুৎ নিরপেক্ষ বা নিস্তড়িৎ বা নিউট্রাল। সবচেয়ে সহজ পরমাণু হচ্ছে হাইড্রোজেন, তার নিউক্লিয়াসটা হচ্ছে শুধু একটা প্রোটন, তাকে ঘিরে ঘুরছে একটা ইলেকট্রন। এরপরের পরমাণু হচ্ছে হিলিয়াম, নিউক্লিয়াসে দুটো প্রোটন (এবং চার্জবিহীন দুটো নিউট্রন) আর বাইরে দুটো ইলেকট্রন। এভাবে আস্তে আস্তে আরো বড় বড় পরমাণু তৈরি হয়েছে। হাইড্রোজেনকে যদি বাদ দিই তাহলে বলা যায় নিউক্লিয়াসে যতগুলো প্রোটন থাকে কমপক্ষে ততগুলো এবং সাধারণত আরো বেশি নিউট্রন থাকে।
নিউক্লিয়াসের বাইরে ইলেকট্রনগুলো সব একই কক্ষপথে থাকে না| ভেতরের কক্ষপথের ইলেকট্রনগুলো অনেক শক্তভাবে আটকে থাকে, তবে কিছু কিছু পরমাণুর বেলায় বাইরের কক্ষপথের ইলেকট্রনগুলোকে একটু চেষ্টা করলে আলাদা করা যায়। ইলেকট্রন আলাদা করার একটা উপায় হচ্ছে ঘর্ষণ।
এমনিতে পরমাণুগুলো চার্জ নিরপেক্ষ অর্থাৎ প্রত্যেক পরমাণুতে সমান সংখ্যক প্রোটন আর ইলেকট্রন। কিন্তু কোনো কারণে যদি বাইরের কক্ষপথের একটা ইলেকট্রন সরিয়ে নেওয়া হয় তাহলে ইলেকট্রনের তুলনায় প্রোটনের সংখ্যা বেড়ে যায় অর্থাৎ পরমাণুটা আর বিদ্যুৎ নিরপেক্ষ বা নিউট্রাল থাকে না, তার ভেতরে পজিটিভ চার্জের পরিমাণ বেড়ে যায়। একটা ইলেকট্রন সরিয়ে নিলে পরমাণুটিতে একটি পজিটিভ চার্জ হয়, দুটি সরিয়ে নিলে দুটি পজিটিভ চার্জ হয়। আমরা তখন বলি পরমাণুটি আয়নিত বা আহিত হয়েছে। একটা পরমাণু যে রকম পজিটিভভাবে আয়নিত হতে পারে ঠিক সে রকম নেগেটিভভাবেও আয়নিত হতে পারে অর্থাৎ যখন বিচ্ছিন্ন একটি বা দুটি ইলেকট্রন পরমাণুর সাথে যুক্ত হয়ে যায়, তখন পরমাণুর মোট চার্জ হয় নেগেটিভ।
পরমাণুগুলোর ইলেকট্রনগুলো তার কক্ষপথে ঘুরতে থাকে, এগুলো কীভাবে সাজানো হবে ভার সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে। তোমরা তোমাদের রসারন বইয়ে সেটি বিস্তৃতভাবে দেখেছ। এখন তার গভীরে আমরা যাব না। শুধু বলে রাখি কখনো কখনো শেষ কক্ষপথে একটি-দুটি ইলেকট্রন প্রায় মুক্ত অবস্থায় থাকে, এ রকম পদার্থে ইলেকট্রনগুলো খুব সহজে পুরো পদার্থের মাঝে ছোটাছুটি করতে পারে। এ রকম পদার্থকে আমরা বলি বিদ্যুৎ পরিবাহী। আবার কিছু কিছু পদার্থে ছোটাছুটি করার মতো ইলেকট্রন নেই, যে কয়টি আছে খুব শক্তভাবে আবদ্ধ সেগুলো হচ্ছে বিদ্যুৎ অপরিবাহী। ধাত পদার্থ যেমন সোনা, রুপা, তামা হচ্ছে বিদ্যুৎ সুপরিবাহী। কাঠ, প্লাস্টিক, কাচ, রাবার এসব হচ্ছে বিদ্যুৎ অপরিবাহী।
পরমাণুর গঠন সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যা যা বলা হয়েছে আমরা যদি সেগুলো বুঝে থাকি তাহলে স্থির বিদ্যুতের পরের বিষয়গুলো মনে হবে খুবই সহজ।
Read more